বাংলা সনের উত্পত্তির ইতিহাস ।

১৪২২ বঙ্গাব্দ বিদায় নিয়ে ১৪২৩ বঙ্গাব্দ হাজির হয়েছে বাঙালির আঙিনায়। বর্ষবরণের প্রস্তুতি চলছে চারদিকে। ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো’— গানের কলিগুলো উঁকি মারছে বাঙালি প্রাণে। 

বাংলা সনের পয়লা তারিখকে কেন্দ্র করে ব্যবসা-বাণিজ্যের হালখাতা নবায়ন করার সংস্কৃতি আবহমানকাল থেকে লালন করে আসছে সর্বস্তরের বাঙালি। ব্যবসার হালখাতার সঙ্গে সঙ্গে জীবন হিসাবের খাতাও নবায়ন করতে হবে। আজ থেকে তওবা করে গুনামুক্ত নতুন জীবন শুরুর মাধ্যমে জীবনের হালখাতা নবায়ন করুক সব বাঙালি। আল্লাহ বলেন, ‘হে ইমানদাররা! তোমরা তওবা কর অর্থাৎ অনুতপ্ত হয়ে ফিরে আসো আল্লাহর দিকে। আর একনিষ্ঠভাবে শুদ্ধ তওবা কর। (সূরা তাহরিম : ৮।) রসুল (সা.) বলেছেন, ‘গুনা থেকে তওবাকারীর অবস্থা এমন, যেন তার কোনো গুনা নেই।’ (ইবনে মাজাহ)। নতুন বছরের প্রথম দিনটি গুনা থেকে তওবা করে সুন্দরভাবে শুরু করতে পারার মাঝে ভিন্ন রকমের কল্যাণ রয়েছে। হিজরি সন থেকে বাংলা সনের উত্পত্তি হয়েছে। মোগল সম্রাট আকবরের আমলে বাংলা সন শুরু হয়। তখন কৃষক হিজরি সন অনুযায়ী খাজনা দিত। চান্দ্রবছরের সঙ্গে বাংলা ঋতু এলোমোলো হয়ে যাওয়ায় কৃষক বিপাকে পড়ে যায়। সিংহাসনে আরোহণ করে আকবর এ সমস্যাটি গভীরভাবে উপলব্ধি করেন। বাদশাহ আকবর এর সুষ্ঠু সমাধানের জন্য ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দ মোতাবেক ৯১২ হিজরি সনে প্রখ্যাত ইরানি জোতির্বিজ্ঞানী আমির ফতেহ উল্লাহ সিরাজিকে দায়িত্ব দেন। আমির ফতেহ উল্লাহ হিজরি সনের সঙ্গে মিল রেখে সৌরমাসভিত্তিক ফসলি সন প্রণয়ন করেন। এ সন হিজরি সনের আদলেই শুরু হয়। ৯৩৬ হিজরি সনে বাংলা সনের জন্ম বছর হলেও তা ৯৩৬ বঙ্গাব্দ থেকেই গণনা করা হয়। শুধু তাই নয়, হিজরি সনের সঙ্গে মিল রাখার জন্য বাংলা সনের প্রথম মাস চৈত্রের পরিবর্তে বৈশাখ করা হয়। তখন পয়লা মহররমের সঙ্গে পয়লা বৈশাখের মিল ছিল। সে থেকেই পয়লা বৈশাখ বাংলা নববর্ষ হিসেবে উদ্যাপিত হয়ে আসছে। সুতরাং বলা যায়, বাংলা সনের সঙ্গে ইসলামী ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং চিন্তা-চেতনা নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। তাই বাংলা সন উদ্যাপনে ইসলামী দৃষ্টিকোণ পরিহার করা মূলত ইতিহাস সম্পর্কে অজ্ঞতারই নামান্তর। আমাদের দেশের আলেমরা দেশীয় সংস্কৃতিচর্চায় পিছিয়ে থাকার কারণে সাধারণ মানুষ ইসলামী ভাবধারার সংস্কৃতিচর্চার রূপরেখা জানতে পারছে না। একদিকে আলেমরা সংস্কৃতিচর্চায় পিছিয়ে অন্যদিকে ফতোয়াবাজি— এ দুই সমস্যা আলেমদের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ করে রেখেছে একুশ শতকের তরুণসমাজের কাছে। পয়লা বৈশাখ বাঙালির প্রাণের উৎসব। এ দিনকে কেন্দ্র করে শরিয়তের বৈধ সীমায় আনন্দ-উৎসব করা দোষের নয়। বৈধভাবে নববর্ষ উদ্যাপনের অনেক পথ ও পন্থা আছে। শুকরিয়ার নামাজ, দান-সদকা, নফল রোজা, কোরআন তিলাওয়াত ও দোয়া মাহফিলের মাধ্যমে নববর্ষ উদ্যাপন করা যেতে পারে। নতুন বছরের নতুন দিনে কোনো অভাবীর অভাব পূরণ করে কিংবা ঋণগ্রস্তকে সাহায্য করে অথবা নিরক্ষর হৃদয়ে অক্ষরের আলো জ্বেলে নতুন বছর শুরু করা ভালো ছাড়া খারাপ হবে না। দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়েও নববর্ষ উদ্যাপন করা যেতে পারে। এ জান্নাতি হাসিই নববর্ষের শ্রেষ্ঠ উপহার হতে পারে আমাদের প্রিয়জনদের জন্য। জুমার খুতবায় নববর্ষের ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং চেতনা নিয়ে আলোচনা করলে তরুণরা সঠিক ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারবে। আমাদের দেশের তরুণরা ধর্মবিরোধী নয়। যুক্তির নিরিখে ধর্মের বিধানগুলো তরুণদের সামনে উপস্থাপন করতে পারলে তরুণরাই ধর্মের নেতৃত্ব দেবে। কিন্তু তরুণদের মানসিকতা বুঝে ধর্মের ব্যাখ্যা করবেন এমন চিন্তাশীল বিশেষজ্ঞ খুব কমই আছে সমাজে। পয়লা বৈশাখ উদ্যাপনের সন্ধিক্ষণে তরুণদের উদ্দেশে কিছু কথা বলতে চাই। আমরা বাঙালির পাশাপাশি মুসলমানও। আমাদেরও একটি পৃথক হিজরি সন আছে। পয়লা বৈশাখ কিংবা ইংরেজি নববর্ষ উদ্যাপনের মতো হিজরি নববর্ষ উদ্যাপনেও তরুণদের এগিয়ে আসতে হবে। অবশ্য এর জন্য আলেম ও মাদ্রাসাপড়ুয়াদের দায়িত্ব নিতে হবে বেশি। আলেমরা হিজরি নববর্ষ উদ্যাপনে কোনো কর্মসূচি, পথর‌্যালি কিংবা জাতীয় কোনো অনুষ্ঠান করেন বলে আমার জানা নেই। ইসলামী সংস্কৃতিচর্চায় আলেমদের এ অনীহা বড় ধরনের গাফিলতি। সর্বোপরি বলতে চাই, নতুন বছর আমাদের জন্য শান্তিময় হোক। কল্যাণের বার্তা নিয়ে আসুক প্রতিটি আদমসন্তানের জন্য। উন্মোচিত হোক ইসলামের বিজয়ের নতুন দ্বার। এ কামনাই করছি মহান আল্লাহর দরবারে। আমিন। 


লেখক : মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী, বিশিষ্ট মুফাসসিরে কোরআন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব 
collected: http://www.bd-pratidin.com/editorial/2016/04/12/138087