গল্প আমাকে ভাবতে শিখিয়েছে। গল্প আমাকে স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছে। গল্প আমাকে কল্পনা করতে শিখিয়েছে। গল্প আমাকে গল্প বলতে শিখিয়েছে।

 রাতের খাবার শেষ হতে না হতেই এ ঘর ও ঘর থেকে, এ বাড়ী ও বাড়ী থেকে চাঁচী, খালারা চলে আসতো। সেই সাত সকালে শুরু হওয়া তাদের লম্বা দিন শেষ হয়েছে! এখন কিছুটা বিশ্রাম। আম্মুকে ঘিরে বসতো। শীত কাল হলে মাঝখানে গরম ছাইয়ের একটা ‘আইলা’ থাকতো। গরম কালে উঠানে বা বারান্দায় খোলা হাওয়ায়। আমি আম্মার কোল ঘেঁষে বসতাম। আম্মু মাঝে মাঝে বিরক্ত হতো। আমি সে সব পাত্তা দিতাম না। আরো ঘেঁষে বসতাম। আম্মার ’আম্মু- আম্মু’ গন্ধ আমার নাকে লাগতো। আমি নিশ্চিন্ত হতাম। আম্মু গল্প শুরু করতো। “সে অনেক আগের কথা…”
,
কত্তো গল্প যে শুনেছি! তার হিসাব নেই। রাজা বাদশার রূপকথা। সাত ভাই চম্পা। গাজী-কালু-চম্পাবতি। নবীজির গল্প। সেই যে হরীণ একটা বাধা থাকতো। ইউনুস (আঃ) এর মাছের পেটে যাওয়ার গল্প। মুসা (আঃ) এর নীল নদ পার হওয়ার গল্প।

,

 
 দেশ-বিদেশের গল্প বলতো। সাদা বিট্রিশদের গল্প। খান সেনাদের গল্প। শেখের ব্যাটার বীরত্বের গল্প। মুক্তিযূদ্ধে সোহাগপুরে পালিয়ে বেরানোর গল্প। চুয়াত্তরে দুঃসময়ের গল্প। আরো আগের টাইটানিকের গল্প। বই-পত্র লাগতো না। আমার আম্মু মুখে মুখে নিজের ভাষায় গল্প বলতো। আমি বিস্ময় নিয়ে শুনতাম। এক মনে শুনতাম। গল্পে আনন্দ থাকতো। দুঃখ থাকতো। সেসব অনুভুতি হারিকেনের রহস্যময় আলোয় আম্মুর চেহারায় আর গলার স্বরে আরো রহস্যময় লাগতো। আম্মুর চোখ চক চক করতো। আমি গল্পের ভেতরে ঢুকে যেতাম। আমি গল্পের আঙ্গিনায় হাঁটতে থাকতাম। আমি গল্পের মানুষের সংগে ঘুরে বেড়াতে থাকতাম।
,
গল্প শুনতে শুনতে আমাদের ছোটোদের চোখে ঘুম চলে আসতো। আমি প্রানপন চেষ্টা করতাম চোখ খোলা রাখতে। পারতাম না। ঝিমিয়ে পড়তাম। কখন যে আম্মু আমাকে ধরে এনে খাঁটে শুইয়ে দিতো তা আর মনেই থাকতো না। এক্কেবারে সকাল বেলা ঘুম ভাঙ্গতো।
,
গল্প আমাকে ভাবতে শিখিয়েছে। গল্প আমাকে স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছে। গল্প আমাকে কল্পনা করতে শিখিয়েছে। গল্প আমাকে গল্প বলতে শিখিয়েছে। এই অসম্ভব অনিশ্চিত পৃথিবীতে গল্প আমাকে একটু জিরোনোর জায়গা করে দিয়েছে।
”Perhaps it is how we are made; perhaps words of truth reach us best through the heart, and stories and songs are the language of the heart.”
আসুন একটা গল্প বলি-
সন্ধ্যা লাগলেই বাসায় ফেরার নিদের্শ ছিলো। বাড়ীতে তখনও বিদ্যুৎ আসেনি। হারিকেন চলে আসতো ঘরে ঘরে। হাত-মুখ ধুয়ে ঘরে আসলে প্রথমে আম্মু ভালো ভাবে সারা শরীর চেক করতো। সারাদিনে কোথায় কোথায় কেঁটে-ছড়ে গেছে। ‘জামবাক’ লাগিয়ে দিতো। তারপর পড়তে বসতাম। অংকের যে সমস্যায়টায় আমি দীর্ঘ দিন ভুগেছি সেটা হলো কোনটা পাঁচ আর কোনটা ছয়!! আম্মু পাঁচ বা ছয় লিখতে বললেই জিজ্ঞেস করতাম ’বন্ধ’ না ’খোলা’? আম্মু বন্ধ বললে ৫ (মুখটা বন্ধ) আর খোলা বললে ৬ (মুখটা খোলা) লিখতাম। এই ভাবে ঘন্টা খানেক কসরৎ করার পর রাতের খাবার।
,

,
টিভি দেখা শেষ হলে, পত্রিকা পড়া শেষ হলে, এসএমএস করা শেষ হলে, ঝগড়া করা শেষ হলে, এই ফেইসবুক থেকে উঠে…বেশী না মাত্র মিনিট বিশেক…..আপনার প্রিয় সন্তানকে, প্রিয় মানুষকে পাশে নিয়ে বসুন। যে কোনো একটা গল্প বলুন।
দেখবেন ভালো লাগছে। গল্প যে আমাদের সবার হৃদয়ের ভাষা।

(সর্বোপরি লেখাটি ভালো লাগলে আপনার বন্ধুদের মাঝে শেয়ার করবেন।)
সংগ্রহ: ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক এর ফেইসবুক স্ট্যাটাস থেকে ।